* নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না এই বেকারিতে, বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি * অস্বাস্থ্যকর-নোংরা খাবার তৈরির প্রতিবাদ করায় সাংবাদিককে লাঞ্ছিত
লাজিজ লাইভ বেকারিতে কাপড় ও কাঠের রং ব্যবহার করা হচ্ছে বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, মিষ্টিসহ নানা রকমের খাবার তৈরিতে। লাজিজ লাইভ বেকারি পণ্যের নামে আসলে আমরা কি খাচ্ছি। এই বেকারির পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। লাজিজ লাইভ বেকারিতে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণেও রয়েছে চরম অব্যস্থাপনা। এ ছাড়াও পণ্য রাখার ঘর যেমন অপরিষ্কার। পোকামাকড়েও ভরপুর। এসব বিষয়ে উত্তরখান মাজার চৌরাস্তা লাজিজ লাইভ বেকারিতে দৈনিক জনতা’র উত্তরা প্রতিনিধি মীর সাজু গিয়ে জানতে চাইলে তাকে হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করা হয়। সর্বোপরি এই প্রতিষ্ঠানের নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। অনুমোদন ছাড়াই বেকারি পণ্যের উৎপাদন এখন নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে মানবস্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন হুমকির মুখে পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও তুরাগ এলাকায় অধিকাংশ বেকারির নেই ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ, স্যানিটারি ও ট্রেডমার্ক ছাড়পত্র। ফলে তদারকির অভাবে উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেকারি। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এসব খাদ্য মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। লাজিজ লাইভ বেকারির কয়েকটি শাখায় গিয়ে দেখা গেছে মানহীন পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। এই বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে কেক, পাউরুটি, মিষ্টিসহ নানা মুখরোচক পণ্য। স্যাঁতসেঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে বেকারিসামগ্রী। বেকারিতে ব্যবহৃত জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। শ্রমিকরা খালি পায়ে এসব পণ্যের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। এ সময় তাদের গা থেকে ঘাম ঝরে পণ্যের ওপর পড়তে দেখা গেছে। আটা-ময়দা প্রক্রিয়াজাত করার কড়াইগুলোও অপরিষ্কার ও নোংরা। ডালডা দিয়ে তৈরি করা ক্রিম রাখা পাত্রগুলোতে ভন ভন করছে মাছির ঝাঁক। কয়েক দিনের পুরনো তেলেই ভাজা হচ্ছে পণ্যসমাগ্রী। অপরিচ্ছন্ন হাতেই প্যাকেট করা হচ্ছে এসব পণ্য। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ছাড়াই বাহারি মোড়কে বিভিন্ন ধরনের বেকারিসামগ্রী বাজারজাত করা হচ্ছে।
অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে পণ্য তৈরির অভিযোগে গত ৩ মে রোববার উত্তরখান মাজার চৌরাস্তা লাজিজ লাইভ বেকারিতে যায় টাইমস ২৪ ডটনেটের সিনিয়র রিপোর্টার ও দৈনিক জনতা’র উত্তরা প্রতিনিধি মীর সাজু। এসময় লাজিজ লাইভ বেকারির কাজপত্র আছে কিনা এবং অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে পণ্য তৈরি করা হচ্ছে কেন জানতে চাইলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মীর সাজুকে ভুয়া সাংবাদিক হিসেবে হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করে। একজন সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হওয়ার সংবাদ শুনে ঘটনা স্থলে যান উত্তরাস্থ সাংবাদিকদের নেতা ও সিনিয়র সাংবাদিক মামুন খান। এসময় তিনি নিজেও বলেছেন মীর সাজু একজন সাংবাদিক। সাংবাদিক মামুন খানের কথাও লাজিজ লাইভ বেকারির ম্যানেজার কোন মূল্যায়ন করেননি। তারপরেও লাজিজ লাইভ বেকারির কর্মচারীরা সাংবাদিক মীর সাজুকে লাঞ্ছিত করে এবং ওই বেকারির কাস্টমার মো. আলামিনকে দিয়েও সাংবাদিককে হেনস্তা করে। এসময় লাজিজ লাইভ বেকারির ম্যানেজার, কর্মচারীরা ও কয়েকজন কাস্টমার মিলে সাংবাদিক মীর সাজুকে ভুয়া সাংবাদিক হিসেবে পুলিশের দেয়ার হুমকি দেয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় আইডি কার্ড, মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা। এসময় সাংবাদিক মীর সাজুর কাছে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দাবি করে। টাকা না দিলে পুলিশকে বলবে সাংবাদিক মীর সাজু চাঁদাবাজি করতে এসেছে। পরে মীর সাজুর স্ত্রীর অভিযোগে উত্তরখান থানার পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। এসময় লাজিজ লাইভ বেকারির মালিক ও ম্যানেজার সাংবাদিক মীর সাজুর কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু লাজিজ লাইভ বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে কেক, পাউরুটি, মিষ্টিসহ নানা মুখরোচক পণ্য। এসব বিষয়ে পুলিশ কিছু করতে পারেনি। কারণ এসব দেখার জন্য রয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও লাজিজ লাইভ বেকারির ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ, স্যানিটারি ও ট্রেডমার্ক ছাড়পত্র দেখার জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে।
জানা যায়, লাজিজ লাইভ বেকারিতে পাউরুটি ফোলানো, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন আকৃতি দিতে ট্রান্সফ্যাট ও মিষ্টিজাতীয় রাসায়নিক সোডিয়াম সাইক্রোমেট নামের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিনও ব্যবহার করা হচ্ছে। লাজিজ লাইভ বেকারির লোকজনের কাছে এটি ‘ব্রেড এনহ্যান্সার’ নামে পরিচিত। সোডিয়াম সাইক্রোমেটের তুলনায় পটাশিয়াম কম দাম হওয়ায় খরচ বাঁচাতে এটা করা হচ্ছে। এছাড়া খাবার মুচমুচে ও সুস্বাদু করার জন্য ব্যবহার হয় সাল্টু বা অ্যামোনিয়াম।
সূত্র জানায়, দেশে দুই ধরনের বেকারি রয়েছে। একটি হস্তচালিত (হাতে তৈরি নন-ব্র্যান্ড) বেকারি। দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজার এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা হাতে তৈরি পণ্য দেশের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। অন্য ধরনটি অটো ও সেমি-অটো বেকারি। দেশে ১০০টির মতো এ ধরনের বেকারি রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড়। এছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী আরও প্রায় ১৫টি কারখানা করেছে। যেগুলো এখন বেকারি ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুজামান বলেন, স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য যারা তৈরি করছেন তাদের ক্ষেত্রে আমরা সমস্যা পাচ্ছি না। তবে হাতে তৈরি বেকারিগুলোর উন্নতি হচ্ছে খুব ধীরে। এখনো কিছু বেকারিতে পা দিয়ে খামির তৈরির মতো ঘটনা হচ্ছে, যদিও সেটা আগের তুলনায় কম। এসব বিষয়ে হাতে তৈরি বেকারি পণ্য উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বলেন, শুরু থেকে কিছু সমস্যা বেকারিতে ছিল। তবে এখন সেসব কাটিয়ে উঠছে। যারা ভালোভাবে নিয়ম-নীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তারাই টিকে থাকতে পারছে। সরকারের নানা সংস্থা এখন তদারকি করছে। এতে অবস্থা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
লাজিজ লাইভ বেকারিতে এ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহারে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে সেটা জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) ড. সহদেব চন্দ্র সাহা দৈনিক জনতাকে বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রুটি, পাউরুটি ও বেকারি খাদ্যে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াম সালফেট, পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিন ব্যবহার করা হচ্ছে এটা সত্য, যা একটি বড় সমস্যা। খাদ্যে এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, ক্যানসার, জিনগত রোগ ও মিউটেশন, ডায়রিয়া, বমিভাব ও পেটের পীড়া তৈরি করতে পারে। এসব রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে ২০২১ সালে, যা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আইন করে এসব নিষিদ্ধ করার আগে আমরা বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের উদ্যোগে একটি গবেষণা করেছিলাম। এতে পাউরুটিতে অনুমোদিত মাত্রার অনেক বেশি পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে-এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। সে সময় চারটি জেলা থেকে ২১টি পাউরুটির নমুনা পরীক্ষা করেন গবেষকরা। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কেজিপ্রতি পাউরুটিতে পাঁচ মিলিগ্রাম মাত্রায় পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহারের অনুমতি দিলেও ৬৭ শতাংশ পাউরুটির নমুনায় তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গত বছরও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন এসব রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা অনেকটা কমেছে। তবে এখনো নির্মূল হয়নি। ছোট ছোট বেকারিগুলো এমনটা বেশি করছে। আমরা চেষ্টা করছি এদের প্রতিরোধ করতে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

লাজিজ লাইভ বেকারি
পণ্যের নামে বিষ কিনে খাচ্ছেন মানুষ
- আপলোড সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:৩৯:৫৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:৩৯:৫৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ